Wednesday, July 4, 2012

সাহিত্য




এক চৈতি এবং টারজানের গল্প
জাহিদ কামাল
একটানা পাঁচ বছর প্রেম করে রানাকে বিয়ে করেই ছাড়লো চৈতি। বাবা মা, ভাই বোন, সবার মতের বিরুদ্ধে। ভার্সিটি ঢুকেই, সেই প্রথম দিনের ক্লাশেই, রানা কেড়ে নিয়েছিল চৈতির সবটুকু চোখ! চৈতির উদাস চোখে এতোদিন কোন পুরুষ পড়েনি, পড়েছে সব খরগোস! আরশোলা! যারা লম্বায় খুব বেশি হলে ফুট কি ইঞ্চি, অবুদ্ধিদীপ্ত চেহারা, কারো মাথায় তেল, কারো গলায় পাউডার। ফিটফাট ইস্ত্রি করা কাপড় পরে ঘর থেকে তারা বের হয়। গরমে ইন করা শার্ট। শীতে সু্যট টাই। বাবার সঙ্গে বিভিন্ন পার্টিতে গিয়ে, বান্ধবীর জন্মদিনে, এখানে সেখানে পিকনিকে গিয়ে- এরকম ছেলে তার চোখে পড়েছে। ওয়েল ড্রেসেড। ওয়েল ম্যানার্ড।
রানাই তার চোখ দুটোকে প্রথম স্থির করে দিল। বুক খোলা শার্ট, ময়লা জিন্সের প্যান্ট, পায়ে বাটার স্পঞ্জ। এলোমেলো রুক্ষ চুল। একহারা লম্বা শরীর, লম্বা চেহারা। শরীরের কোথাও মেদ নেই। ভার্সিটির তিন তলায় কড়িডোরের এক কোনায়, রেলিংয়ে বসে বই পড়ছে। রকম বিপজ্জনক রেলিংয়ে বসে নিবিষ্ট মনে বই পড়তে গিয়ে ছেলেটি উল্টে পড়ে যেতে পারে। অবশ্যি আজ কালকার ছেলে মেয়েরা এর চেয়ে বিপজ্জনক খেলা প্রায় সবসময়ই খেলে! নো ডেনজার। চৈতি এক পা দু'পা করে এগিয়ে গিয়েছিল। কি পড়ছে অমন নিবিষ্ট চিত্তে, সেটা দেখবার জন্য। মাসুদ রানা? হুমায়ুন আহমেদ, তসলিমা নাসরিন, সমরেশ মজুমদার, কি পড়ছে?
কাছে গিয়ে বইয়ের কভারে চোখ পড়তেই চমকে উঠলো চৈতি। তারিক আলীর একটি রাজনৈতিক বই,'ক্যান পাকিস্তান সারভাইভ?' এই বইটি পড়ছিল সে। চৈতির বাবা এই বইটি তাকেও পড়তে দিয়েছিলেন। পাকিস্তানের রাজনীতি, রাজনীতিতে আর্মির ভূমিকা, জুলফিকার আলী ভুট্টোর রাজনৈতিক ভুল- সব নিয়ে একটি দারুন গতিশীল বই হচ্ছে- 'ক্যান পাকিস্তান সারভাইভ' চৈতির প্রেমের শুরু সেই থেকে। অমন রুক্ষ ব্রুট এলোমেলো একটা পুরুষ এবং তার হাতে তারিক আলীর বই- ইমপ্রেস হবার জন্য যথেষ্ঠ ছিল। প্রথম দর্শনেই প্রেম- কথাটাই বরাবরই হেসে উঠেছে চৈতি। সে চৈতি', ঘয়েল হলো প্রথম দর্শনেই। টিএসসি' চত্ত্বর, রমনার সবুজ ঘাস, ক্রিসেন্ট লেক- এর একটিতেও তারা যায়নি। চাইনিজে গিয়ে সু্যপ খাওয়া, গুলশানের ক্যান্ডি ফ্লসের সামনে দাড়িয়ে গরম কফিও খায়নি। রানার বাসায় না ছিল কোন ফোন, না ছিল কোন মোবাইল- যে তারা কথা বলবে। তবুও সখ্যতা গড়ে উঠেছিল।
প্রথম কি করে বুঝেছিল চৈতি, যে সে এক গভীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে? দুর্দান্ত সাজতো চৈতি, ব্যাগ ভর্তি থাকতো কসমেটিকস। সেই চৈতি সব কসমেটিকসের ব্যবহার বন্ধ করে দিল। রুক্ষ ব্রুট রানার পাশে ঠোট লাল বা খয়েরী রং মানায় না। যেমন মানায় না গালে ক্রিম, হাতের নখে কৃত্রিম রং। শুধু একটা পারফিউম, এই ছিল চৈতির একমাত্র কসমেটিকস। ক্লাসের ফাকে কড়িডোরে দাড়িয়ে কিছুক্ষণ কথাবার্তা, ক্লাশ শেষে সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে কথা- এই ছিল ওদের সার্বিক এবং সাপ্তাহিক বাক্যালাপ। চৈতি গাড়িতে উঠে বসতো বাসায় যাবার জন্য, কিন্তু রানা একটি দিনেও জন্যও চৈতির গাড়ির কাছে আসেনি, টা টা, গুডবাই- এসব বলার জন্য। চৈতির খুব ভাল লাগতো রানার এই না আসাটি।
চৈতির কিছু বান্ধবী অত্যন্ত উদারতা থেকে তাদের নিভৃত বাসায় রানা এবং চৈতিকে নিভৃতভাবে মিশবার অফারও করেছিল। চৈতি জানে ওর সব বান্ধবীরাই এরকম। কেবল ওরাই জানে না চৈতি কেমন। ওদের ব্যাগে থাকে লেটেস্ট এইডস প্রতিরোধক এক টুকরো প্যাকেটে বন্দি পাতলা ফিনফিনে রাবার। চৈতির ব্যাগে থাকে কোন না কোন কবিতার বই।
হুট করেই বিয়ে করেছিল চৈতি। বাবা মা আপত্তি করেছিলেন। রানার বাবা মা, ভাই বোন কেউ নেই বলে। থাকে মেসে, করে টিউশনি। সর্বসাকুল্যে দুটো প্যান্ট, দুটো শার্ট, এক জোড়া জুতোও নেই। বাবা মা' আপত্তিটাই স্বাভাবিক। জীবনে এই প্রথম চৈতি তার বাবা মা' বিরুদ্ধে গিয়েছিল। রানাকে হয়তো সে তার বাড়িতে আনতে পারতো। এই বাড়ির মালিক চৈতিই, চৈতির নানী এই বিশাল বাড়ি এবং তার বিশাল ঐশ্বর্যের সবটুকুই চৈতিকে দিয়ে গেছেন। চৈতির মাও বিয়ে করেছিলেন প্রেম করে, বাবা মা' অমতে। চৈতির রক্ষণশীল নানী সেটা কখনোই মেনে নেননি। চৈতির মা ছিলেন তার বাবা মা' একমাত্র সন্তান। সেই সুবাদেই চৈতি এই বিশাল ঐশ্বর্যের মালিক হয়েছে।
তারপরে চৈতি রানাকে নিয়ে তার নিজের বাড়িতেই ফিরেনি। একটা বাড়া বাসায় উঠেছিল। সব খরচ নানার কাছ থেকে পাওয়া বিজনেস থেকেই আসতো। পাশাপাশি রানা তার টিউশানিটুকুও ধরে রেখেছিল। চৈতি তাতে আপত্তি করেনি। যেমন রানাও আপত্তি করেনি চৈতির বিত্ত এবং বৈভবে। প্রতিটি মানুষের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র এবং স্বকীয়তা থাকা দরকার। কি বিয়ের আগে, কি বিয়ের পরে। কি স্বামীর, কি স্ত্রীর।
ছোটবেলায় চৈতিকে দারুনভাবে আলোচিত করেছিল একটি ছবি- টারজান। ব্রিটিশ কাউন্সিলের অডিটোরিয়ামে দেখা এই টারজান ছবিটি আর ৫০টা টারজান ছবি থেকে আলাদা। অন্যসব টারজান ছবিতে টারজান মেয়ের প্রেমে জঙ্গল ছেড়ে, জীবজন্তু ছেড়ে, নারীর বাহুবন্দি হয়েছে। জঙ্গল ছেড়ে চলে এসেছিল প্রাসাদে। তারপর সেই সাদামাটা কাহিনী- বন্য টারজানকে সভ্য করে তোলা। তারপরই কাহিনী শেষ। কিন্তু ব্রিটিশ কাউন্সিলে দেখা সেই টারজান ছিল একদম বিপরীতধর্মী। জঙ্গল ছেড়ে নায়িকার সাথে টারজান ঠিকই চলে এসেছিল নায়িকার ঘরে। কিন্তু নায়িকার চিকন পাতলা ঠোট, মসৃন মোজাইক তলপেট, প্রাণভেদী প্রেম, কোন কিছুই এই টারজানকে বেধে রাখতে পারেনি। নায়িকাকে নিয়ে রাতের বেলায় বন্য খেলার পর টারজান আবারো শুনতে পেতো গভীর বনের হাতছানি। একদিন সকালবেলা সবার অজান্তেই টারজান চলে গিয়েছিল সেই জঙ্গলেই। শহর, শহরের মেকি সভ্যতার মেকি মানুষ, মেকী মানুষের অশোভনীয় কৃত্রিমতায় হাপিয়ে উঠেছিল টারজান। তার কাছে অনেক অনেক প্রিয় ছিল বনের সাদামাটা জীবজন্তুরা।
টারজানকেই চৈতি আবিস্কার করেছিল রানার মাঝে। তাই কোন কিছুকেই সে তোয়াক্কা করেনি। এক বুক বন্যতা নিয়ে সে নিঃস্বার্থভাবে নিজেকে সপে দিয়েছিল টারজান ইমেজ নিয়ে আসা রানার কাছে। রানাকে দেখে দেখে চৈতির মাঝে কখন যে একটি ক্ষুধার্ত চিতা বাঘিনী একটু একটু করে ঢুকে পড়েছিল সেটা চৈতি আসলে বুঝতে পারেনি। নারীর সবটুকু ক্ষুধা ওকে গ্রাস করেছিল।
প্রথম রাত, দ্বিতীয় রাত এভাবে পর পর প্রায় ১৫ টি রাত এক রকম অর্থহীনভাবেই কেটে গেল। সেই চিতাবাঘিনীর সবটুকু ক্ষুধা ক্ষুধাই রয়ে গেল।
হতবাক হওয়া চৈতি রানাকে সরাসরিই বললো, তোমার বোধহয় ডাক্তার দেখানো উচিৎ। নির্বিকার রানা এক কথাতেই রাজি হয়ে গেল। ঠিক হলো পরদিন বিকেলে ওরা ডাক্তারের কাছে যাবে। ঢাকার বিখ্যাত সেঙ্ স্পেশালিস্টের কাছে বিশেষ এপয়েন্টমেন্টও নিয়ে রাখলো চৈতি।
সকালে ঘুম থেকে উঠে বিশেষ একটা কাজে চৈতি ওর গাড়িটা নিয়ে বের হয়ে পড়লো, ফিরলো দুপুর ১২ টার দিকে। চৈতি যখন যায় তখন রানা ঘুমাচ্ছিলো, ফিরে এসেও দেখে রানা ঘুমাচ্ছেই। ডাক দিলো, রানার ঘুম থেকে উঠবার লক্ষণ নেই। একটা বালিশ বুকে জড়িয়ে পাশ ফিরে জরোসরো হয়ে শুয়ে আছে। আবারো ডাকলো চৈতি। কোন নড়াচড়াও নেই। এবার গায়ে হাত দিয়ে ধাক্কা দিতেই চৈতি জমে পাথর হয়ে গেল। ঠান্ডা বরফ শরীর, রানা আর নেই। বালিশের পাশেই ছোট একটা ডায়রী, পাশে একটি কলম। ডায়রীটা খুলে ধরলো চৈতি চোখের সামনে। লেখাগুলো স্পষ্ট উঠে এলো ওর চোখের পর্দায়। 'চার বছর আগে কলেজের একটি গন্ডগোলে পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। পুলিশ যা করে আমার ক্ষেত্রেও তাই করেছিল প্রচন্ড নিপীড়ন- অত্যাচার- নির্যাতন। প্রায় মাস ছিলাম পুলিশের হেফাজতে। রিমান্ডে পুলিশ বারবার আমাকে জেল থেকে নিয়ে এসেছে থানার হাজতে। তারপর আবারো সেই একই ধরণের অত্যাচার। আমি কখনো ছাত্র রাজনীতি করিনি। সন্ত্রাসীও ছিলাম না। আমার কোনো সন্ত্রাসী কিংবা রাজনৈতিক বন্ধুও ছিল না। অথচ পুলিশ চাইছে আমার কাছ থেকে সেই সব তথ্য, আমার কাছে কয়টা টিস্তল আছে এবং কোথায় সেইসব অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছি। জানতে চেয়েছে আমার সন্ত্রাসী বন্ধুদের নাম। আমি কোন কিছুই বলতে পারিনি। বলবই বা কি করে। অবশেষে মাস পর আমার মুক্তি ঘটলো। জেলের ডাক্তারই আমাকে বলেছিলেন, পুলিশী নির্যাতনে আমার শিরদাড়া স্পাইনাল কর্ডের ড্যামেজ হয়েছে। আমি ঠিকমতো দাড়াতে পারছিলাম না। হাটতে অসুবিধা হচ্ছিলো। সেই কারনেই জেল কর্তৃপক্ষ চিকিৎসার আয়োজনটি করেছিলেন। সেই সময় ডাক্তার একটা কথা বলেছিলেন যা এখন মনে পড়ছে চৈতি। ডাক্তার বলেছিলেন, চিকিৎসায় তুমি সেরে উঠবে, হাটতে দৌড়াতে পারবে আগের মতোই। তবে সেঙ্ েতোমার একটা পার্মানেন্ট সমস্যা হবার দারুন সম্ভাবনা আছে। চৈতি কথাটা আমি একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম। ভুলে যাবার কারণ আমি কখনোই কোন মেয়েকে নিয়ে ভাবিনি। তুমি আমার জীবনে আসবার পরও ভুলেও একবারও আমার মনে হয়নি। জীবনে কখনো একটি বারের জন্যও যদি কোন একটি মেয়ের সঙ্গে মিশতাম তাহলে ব্যাপারটা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে যেতো। তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো এজন্য আমার কোন দূঃখবোধ নেই। শুধু দূঃখ হচ্ছে তোমাকে ছেড়ে যেতে। গুডবাই চৈতি।'




শুধুই শিলা
জাহিদ কামাল

 বাবার মৃত্যু সংবাদে দেশে ফিরে এলো শিলা৷ শিলা আমেরিকায় বিজনেস ম্যানেজমেন্টে পড়ছিল৷ বাবাই পাঠিয়েছিলেন শিলাকে বাইরে; একটিই সন্তান তার, পড়া শেষ না হতেই বাবার মৃতু্য সংবাদে ছুটে এলো শিলা দেশে৷ বিশাল বাড়ি, ৮/১০ টা গাড়ি, কয়েকটা কারখানা এবং এক্সপোর্ট ইমপোর্ট ব্যবসা সব মিলিয়ে বিশাল এক সাম্রাজ্য৷ যার সবটুকুর মালিক শিলা একা৷ ওর কেউ নেই৷ মা মারা গেছেন অনেক আগেই৷ চিকন ঠোঁট, চিকন কোমড়, ডিমের মতো ত্রিকোন মুখ- সব মিলিয়ে শিলা প্রায় অসামান্য এক সুন্দরী যুবতী৷ গাম্ভীর্যের মাঝে সব সময়ই উঁকি দিয়ে বেড়ায় এক টুকরো হাসি৷ বাবার ব্যবসার সব কিছু বুঝে নিতে শিলার খুব বেশি সময় লাগবে না৷ হলোও তাই৷ ওদের ফার্মের সব পুরনো স্টাফদের ধারণা হয়ে গেলো যে ওর বাবার চেয়েও ভালো ব্যবসা চালাতে পারবে শিলা৷ ঠিকঠাক চলতে লাগলো সব কিছুই৷ হঠাত্‍ একদিন একটা ফোন এলো, করেছিল রাজিব৷ রাজিব ওদের দুর সম্পর্কের আত্মীয়, তার বাবার কাছে থেকেই মানুষ হয়েছে৷ অনাথ এবং গরীব রাজিব প্রায় ১৫ বছর তাদের বাড়িতে থেকেছে৷ শিলা ওকে দেখেও দেখেনি৷ ওদের বাড়িতে অনেকেই থাকে৷ যেমন ম্যানেজার, মালি, কুক, গার্ড, ড্রাইভার, চাকর বাকর৷ তেমনি ছিল রাজিব৷ আলাদা ভাবে রাজিবকে সে কখনোই দেখেনি৷ বিসিএস পরীক্ষায় খুব ভাল রেজাল্ট করে রাজিব ওর জন্য একগুচ্ছ রজনীগন্ধা এনেছিল সঙ্গে একটা টুকরো চিঠি৷ শিলা সেটা হাতে নিয়েই রমাকে দিয়ে টেবিলে রাখতে বলেছিল৷ রমা ওর ব্যক্তিগত আয়া ছিল৷ এখন বিয়ে হয়ে কোথায় গেছে জানে না৷ রজনীগন্ধটা ওভাবে রেখে সে দ্রুত বাইরে একটি জরুরী কাজে চলে গিয়েছিলো৷ বাইরে কোথাও গেলে শিলা একাই বের হতো, ড্রাইভারকে সঙ্গে নিতো না৷ ড্রাইভারের ধীর গতির হাড়ি চালানো তার মেজাজের একেবারে বাইরে ছিল৷ গাড়ি মানেই দুরন্ত গতিতে ছুটে চলা৷ এই হচ্ছে শিলা, সব ক্ষেত্রেই ওর গতি দারুন দ্রুত৷ সেই রাজিব ফোনে শিলাকে বললো, কেমন আছো? বাবার মৃতু্যর ধকল টাকে দ্রুত কাটিয়ে উঠে বাবার টোটাল বিজনেসটাই খুব ভালভাবে দেখছো সে খবরও জেনেছি৷ থ্যাংকস এন্ড বাই, বলে শিলা ফোনটি রেখে দিয়েছিল৷ শিলা শুনেছে রাজিব দুনর্ীতি দমন বিভাগের মস্ত বড় অফিসার৷ এ দেশের ১ নম্বর কর্নধারও হতে পারে৷ ক'দিন পরেই দুনর্ীতি দমন বিভাগ থেকে ওর নামে সরাসরি একটি চিঠি এলো৷ শিলার বাবার এত বড় ব্যবসা এত কারখানা কিভাবে করেছেন তার বিশদ বিবরণ রয়েছে পুরো চিঠি জুড়ে৷ ইমকামট্যাক্স ফাঁকি, বেনামিতে সম্পত্তি করা এর সঙ্গে রয়েছে সম্পত্তির উত্‍সের কিছু অবৈধ তথ্য৷ ৭ দিনের মাঝে উত্তর দেবার একটি কথাও লেখা আছে সেই চিঠিতে৷ শিলা চিঠিটি পড়ে কিছুক্ষণ ভাবলো তারপর দুমরে মুচরে ফেলে দিলো ওয়েস্ট পেপার বক্স৷ে
সেই রাতেই রাজিব আবারো ফোন করলো, কোন চিঠি পেয়েছ কি দূর্নীতি দমন বিভাগ থেকে? শিলা উত্তর না দিয়ে রিসিভারটি কানে ধরে রাখলো৷ রাজিব বলে উঠলো, কিছু ভেবনা কাল আসছি৷ চিঠির একটা উত্তর তৈরী করে তোমাকে দিয়ে আসবো৷
কোন প্রয়োজন নেই- কথাটা বলেই শিলা ফোন রেখে দিল৷ পরদিন সকালে শিলা তার সলিসিটারকে যেকে পাঠালো৷ বিখ্যাত আইনজীবি হিসেবে রমেশ কাকার যথেষ্ট খ্যাতি রয়েছে৷ বাবার ঘনিষ্ট বন্ধু, সেই সুবাদে শিলাকে কন্যা স্নেহে দেখে থাকেন৷ চিঠিটা ওয়েস্ট পেপার বক্স থেকে পুনরুদ্ধার করার পরেই রমেশ কাকা বলে বসলেন, এত সব গোপন তথ্য দূনর্ীতি দমন বিভাগ পেলো কি করে? এসব আমি এবং তোমার বাবা ছাড়া ম্যানেজারও জানে না৷
শিলা ঠান্ডাভাবে বললো, যেভাবেই হোক তারা যখন এই সব তথ্য পেয়েছে তখন আপনি এগুলোকে ম্যানেজ করুন৷ যা টাকা লাগবে দেবো৷
দু'দিন পর রমেশ কাকা ফোনে শিলাকে বললেন, তোমাদের বাসায় যে ছেলেটি থাকতো, সেই রাজিব এখন এন্টিকরাপশনের ডিরেক্টর৷ তার সঙ্গে সব আলাপ করেছি, উনি আজ রাতে তোমাকে ফোন করবেন, ফোনে পুরো ব্যাপারটাই বলো৷ অতএব চিন্তার কোন কারণ নেই৷
রাতে যথারীতি রাজিবের ফোন এলো৷ রাজিবের সেই এক কখা তুমি না বললেও আমি কাল আসছি৷ রমেশ কাকু এসেছিলেন, তাকে বলেছি এ ব্যাপারে তুমি যেনো চিন্তা না করো৷
শিলা এই প্রথম এই প্রসঙ্গে কথা বলে উঠলো৷ মিস্টার রাজিব, এই দেশে এমন একজন শীর্ষ কোটিপতির নাম বলতে পারবেন, যার কোটি কোটি টাকার ভেতর অবৈধতা নেই, নেই কর ফাঁকি দেয়ার সুক্ষ্ন লুকোচুরি? আপনি আমাকে এই চিঠি কেন দিয়েছেন, তার কারন আমি জানি৷ আপনাকে কাল আসতে হবে না৷ বাই দ্যা বাই, একটা কথা বলছি, বোধহয় জীবনে এই প্রথম আপনার সঙ্গে এতো দীর্ঘ সময় কথা বললাম৷ ফোনটা রাখতে যাবার আগে শিলা তার শেষ অস্ত্রটি নিক্ষেপ করলো৷ আজ যে চেয়ারে আপনি বসে আছেন, সেটা আমার বাবার করুনা এবং বদান্যতায়৷ মানুষ যে এত আরগ্রেটফুল হতে পারে আপনাকে দেখেই সেটা প্রথম উপলব্ধি করলাম৷ ৭ দিন পর থেকে প্রতিদিন একটা করে চিঠি আসতে শুরু করলো৷ দুনর্ীতি দমন বিভাগের সরকারী চিঠি৷ শিলার বাবার প্রতিটি ব্যবসার কর ফাঁকির এবং ব্যবসার অবৈধতা প্রসঙ্গে৷ চিঠিগুলো এলো আদালত থেকে, হঠাত্‍ রাজিব শিলার বাবার পুরো ফাইল দূর্নীতি দমন থেকে কেস আকারে আদালতে পাঠিয়ে দিয়েছে৷
রমেশ কাকা ছুটে এলেন৷ মুখে অজস্র চিন্তার চাপ নিয়ে শিলাকে বললেন, এত সুন্দরী এবং ওয়েস্ট্রান ওয়াল্ড্রে লেখাপড়া শিখে সামান্য এক রাজিবকেই বশ করতে পারলে না৷ তুমি জানো, এই কেসগুলোর পরিণতি কি হবে? প্রতিটি কেসেই আমরা হেরে যাব৷ শুনেছি রাজিব কড়া আফিসার৷ তবে, সে যত কড়াই হোক তুমি চেষ্টা করলেই ওকে সহজেই ম্যানেজ করতে পারবে৷ এখনো সময় আছে, দূর্নীতি বিভাগ ইচ্ছে করলে রিভিউ করার জন্য আদালত থেকে পুরো কেসগুলো ফিরিয়ে আনতে পারে৷ আনতে যদি নাও পারে তবে এখনো কোন না কোন ভাবে দু'চারটা তথ্য দিয়ে কেসগুলো দূর্বল করে দিতে পারে৷ যেখান থেকে আমাদের জেতা সহজ হতে পারে৷ তুমি আজ রাতেই রাজিবের বাসায় গিয়ে দেখা করবে৷ কথাগুলো বলেই রমেশ কাকা চলে গেলেন৷
সেই রাতে শিলা বাথটাবে অনেকক্ষণ গোসল দিলো৷ ক্যাসেটে বারবার কনিকা দেবব্রত শুনলো৷ শুনলো আল স্টুয়ার্ট নীল ডাথমগু৷ দেশে এসে এই প্রথম শ্যাম্পেনও খেলো৷ খুব ভাল লাগছে শিলার৷ ইচ্ছে করছে ছাদে গিয়ে হাতে দড়ি নিয়ে লাফিয়ে লাফিলে খেলতে৷
একটার পর একটা কেস হারতে থাকলো শিলা৷ একটার পর একটা কারখানায় সরকারী তালা ঝুলতে লাগলো৷ প্রতিটি কেসে হেরে যাবার ব্যাপারটা প্রতি রাতেই সেলিব্রেট করতে থাকলো শ্যাম্পেন দিয়ে৷ এভাবে একদিন সব শেষ হয়ে গেলো৷
সর্বশেষ রাজিব মিশাইল এসে আঘাত হানলো ওদের থাকবার বাড়িটিতেও৷ যে জায়গার উপর বাবা এই বিশাল বাড়ি তৈরী করেছেন, সেই জায়গাটি নাকি যথাযথভাব কেনা হয়নি৷ এই কেসেও হেরে গেলো শিলা৷ পুলিশ এসে যখন বাড়িতে তালা লাগাচ্ছে, শিলা তখন রাস্তায়, সামনে ওর প্রিয় গাড়িটি৷ হাতে ছোট একটা ব্যাগ৷ কাঁধে ঝুলছে আর একটি ব্যাগ৷ টেলিগ্রামে বাবা মারা গেছেন এটা তাকে জানানো হয়নি৷ জানানো হয়েছিল, বাবার অবস্থা খুব খারাপ৷ ও রিটার্ন টিকিট কেটেই প্লেনে উঠেছিল৷ ও যখন গাড়িতে উঠতে যাবে, তখন আর একটি গাড়ি এসে ওর পাশে দাঁড়ালো৷ গাড়ি থেকে রাজিব নামলো৷ সু্যট-বুট-টাই পরা রাজিব ধীর পায়ে এগিয়ে এলো শিলার দিকে৷ এসে বললো, পৃথিবীর কোন ঝড়েই কি তুমি নোয়াবে না?
কোন উত্তর না দিয়ে শিলা গাড়িতে উঠে বসলো৷ সবটুকু আকুতি- আর্তি-মিনতি মেথে রাজিব বলে উঠলো শিলা আমি তোমাকে নিতে এসেছি৷ 'তোমাকে ভালবাসি' এই দুটো শব্দ গত ১৫ বছরে বলতে পারিনি; যা যা হারিয়েছ, সব এখনো ফিরিয়ে আনা সম্ভব৷ মিস শিলা, চলো আমার সঙ্গে৷
শিলা গাড়িতে স্টার্ট দিলো৷ ওর চোখে তখন প্লেন উড়ে বেড়াচ্ছে৷ 

জাহিদ কামাল
সম্পাদক
দৈনিক আজ ও আগামীকাল
বগুড়া, বাংলাদেশ৷




ক্ষমা করো না, চে 

হিমালয়ে কেটেছে আমার ব্যক্তিগত জীবন
পোকামাকড়ের সাথে বরফ মিশে
খেয়েছি দীর্ঘদিন; নাড়াচাড়ার জন্য
একবার এপাশ ওপাশ করে রেকর্ড
গড়েছি অলিম্পিকে;
একটামাত্র জীবনে ঘুমানো হয়নি কখনো

আমার হাসি কান্না এবং যাবতীয় শোকগাঁথা
ঢাকা পরেছে নৈমন্তিক তুষারপাতে;
বোকার মত একজীবন কাটিয়েছি উত্তর হিমালয়ে
এক বুক অগ্নেৎপাত- দাবানলের সব
গিলে ফেলেছে কুয়াশা; আমার
আর কোন দূঃখ কষ্ট দেখিনি কখনো। যদিও
দূঃখ-কষ্ট ছাড়া আরকিছু এদিকে আসেনি

ষাট বছর পর যখন মূলতঃ বৃদ্ধবস্থা আমার
চেয়ে দেখি একজন বিশুদ্ধ অ_পুরুষত্বে
কাঁটাতারে ঘেরা আমিত্ব;
সমস্ত রক্ত মাংসেই হিম শীতলতার চূড়ান্ত ঠিকানা;
তবে মৃতু্যর আগে বুঝে উঠেছি সবে_ আমি
নিজেই একটা বিক্ষত হিমালয়_ শুষ্ক বঙ্গোপসাগর
ধাপে ধাপে মৃতু্য যাকে ঘিরে ফেলেছে প্রাগৈতিহাসিক
তারপরও যে বিপ্ল্লবে আসতে পারেনি
ক্ষমা করো না চে_ তারপরও ব্যর্থদের
ক্ষমা করতে নেই

ভন্ডদের রাইফেলের সামনে দাঁড় করাও চে
ব্রাশফায়ার করো কলজে বরাবর;
যে রিকশা থেকে নেমে বিপ্লবের কথা বলে তাকে
গলা টিপে মারো_ যে বিপ্ল্লবের বক্তৃতায়
ক্লান্ত হয়ে শীতলরুমে ঘুমোতে যায়; তাকে ঠেলে
দাও ক্ষুধার্ত সিংহের দরজায়_ যে তিনতারা বলয়ে
বিপ্লব বিপ্ল্লব বলে গলা শুকিয়ে ফেলে
তার মুখে ঢেলে দাও এক পেগ তাজা এসিড_
বিপ্ল্লবের রাজটিকা পরে যে কমরেড
সাম্রাজ্যবাদেও পয়সায় দুপুরের ভাত খায়
তার গলায় পরিয়ে দাও গ্রেনেডের মালা;
ওরা বিপ্ল্লব নষ্ট করে। ওরা হজ্জ করে এসে
ভগবানের পুঁজো করে_ওদের মরতে দাও
ক্ষমা করো না চে_ তারপরও ব্যর্থদের
ক্ষমা করতে নেই

যে বিপ্ল্লব জানেনা_ কোন শব্দ শোনেনি
বিপ্ল্লব বলে_ যে কোন সেমিনার সিম্পোজিয়ামের
পেছনের চেয়ারেও বসেনি কোনদিন;
দু'বেলা খাবার জোটাতে যার কেটে যাচ্ছে একচলি্ল্লশের
শেষ যৌবনটুকুও_ সে যদি কোনদিন
ধনবাদীদের দিকে লাল চোখে তাকায়, ওর মাথায়
হাত বুলাও চে_ওকে আর্শিবাদ করো_
সেইতো বিপ্লবের অগ্নিপুরুষ

চে, আজ তোমার বোধ নেই আমাকে শোনার
তোমার বোধ নেই আমাকে ক্ষমা না করার-
ওদের ক্ষমা না করার_ওর মাথায় হাত বুলাবার;
তবু তোমাকে বলবো, বিপ্ল্লব সফল হবেই
একদিন শ্ল্লোগান উঠবে দুনিয়াজোড়া_নব্বইজনই
এসে দাঁড়াবে সব রাজাদের প্রজাপথে_সব প্রাসাদ তাক
করে তর্জনী উঠবে_ ধনবাদের ইট ধসে
পরবে এক মিছিলের চিৎকারে;
চে বরং ধনবাদীদেরই ক্ষমা করে দাও_বরং
অপেক্ষা করো সব মজুরের চোখ লাল হবার

কোটি কোটি বছরের এক বয়সী পৃথিবী আরো হাজার
বছর না হয় ওরা অধিকারে রাখবে;
কিন্তু তারপর। তারপর যখন নব্বইজন হয়ে
উঠবে এক একজন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চে; তখন
লেফ রাইট লেফ রাইট করা সব সৈন্যরা
রাইফেল ছেড়ে পালাবে_ সব পুঁজিবাদীরা
জোরহাত করে লাইনে দাঁড়াবে_তুমি ওদের
ক্ষমা করো চে;
তারপরের সূর্যটাইতো দাউদাউ করে জ্বলে
উঠবে তোমার স্বপ্নে। পৃথিবী শুদ্ধ হবে।
হালের হিলিয়াম বাতিগুলো থেকে
বেরোবে সবুজ সবুজ প্রাণরঙ

অংশু মোস্তাফিজ জলেশ্বরীতলা, বগুড়া, বাংলাদেশ। 

 

No comments:

Post a Comment